প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী সম্বন্ধে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি এবং দায়িত্ববোধের পরিবর্তন লক্ষণীয়। সাম্প্রতিকালে বিভিন্ন দেশ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রতিবন্ধী বিষয়ক বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণের অঙ্গীকার প্রদান করেছে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬১ তম অধিবেশনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার সনদ অনুমোদিত হয়,যা ৩ মে, ২০০৮ তারিখ থেকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন হিসেবে কার্যকর হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার উক্ত সনদে স্বাক্ষর ও অনুসমর্থন করেছে এবং এর ঐচ্ছিক প্রতিপালনীয় বিধি-বিধানেও স্বাক্ষর ও অনুসমর্থন করেছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫, ১৭, ২০ এবং ২৯ অনুচ্ছেদে অন্যান্য নাগরিকদের সাথে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমসুযোগ ও অধিকার প্রদান করা হয়েছে। সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতাহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ পরিস্থিতিজনিত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার রয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরুক্ষা আইন ২০১৩ এর তফসিল ১১ (ক) তে- বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও দারিদ্র দূরীকরণ কর্মসূচিতে, পর্যায়ক্রমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিবন্ধী ব্যাক্তি, বিশেষ করে, দুঃস্থ ও অসহায় প্রতিবন্ধী শিশু, প্রতিবন্ধী নারী এবং বয়স্ক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অর্ন্তভুক্তি নিশ্চিত করার বিষয়ে বলা হয়েছে। অনগ্রসর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করছে। সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে সরকার তার সাংবিধানিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে ‘প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান কর্মসূচি’ বাস্তবায়ন করছে।
কর্মসূচি শুরুর বছর:
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দরিদ্র, অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত প্রতিবন্ধী শিশু কিশোরদের শিক্ষা লাভের সহায়তা হিসেবে ২০০৭-০৮ অর্থ বছর থেকে ‘প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান কর্মসূচি’ প্রবর্তন করা হয়েছে। শুরুতে এ কর্মসূচিতে উপবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ২০৯ জন; মাসিক উপবৃত্তির হার প্রাথমিক স্তরে ৩০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৪৫০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৬০০ টাকা এবং উচ্চতর স্তরে ১০০০ টাকা ছিল। পর্যায়ক্রমে উপবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও উপবৃত্তির হারও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
কর্মসূচির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য :
১. প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সামাজিক সুরক্ষা, কল্যাণ ও উন্নয়ন;
২. প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সমাজের মূলধারায় আনয়ন;
৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি, উপস্থিতির হার বৃদ্ধি, ঝরেপড়া রোধ করে সুশিক্ষায় শিক্ষিতকরণের
মাধ্যমে মনোবল বৃদ্ধি করা;
৪. জাতীয় উন্নয়নে প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েদের অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি;
৫. প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সুদৃঢ়করণ;
৬. দরিদ্র প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করে উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলা;
৭. প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণ ও সামাজিক সুরক্ষায় সরকার কর্তৃক গৃহীত স্বল্প,মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনায়
সন্নিবেশিত বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা রাখা।
কর্মসূচির পরিধি :
ক) বাংলাদেশের সকল উপজেলা, সকল শ্রেণীর পৌরসভা, এবং সিটি কর্পোরেশনের থানাসমূহে সরকার কর্তৃক স্বীকৃত সকল ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীগণ প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচির আওতাভুক্ত হবে।
খ) প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচির আওতাভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান :
১.সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এর নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান;
২.সরকারি, রেজিস্টার্ড বেসরকারি ও সরকারি তালিকাভুক্ত বেসরকারি প্রাথমিকবিদ্যালয়;
৩.সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়;
৪.সরকারি ও বেসরকারি কলেজ;
৫.সরকার কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সকল মাদ্রাসা;
৬.সরকারি ও সরকার অনুমোদিত চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়;
৭.পাবলিক ও সরকার অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়;
৮.সরকার অনুমোদিত কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান;
৯.সরকার কর্তৃক স্বীকৃত বেসরকারি/স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান পরিচালিত সকল শ্রেণীর প্রতিবন্ধী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
শিক্ষার্থী নির্বাচনের মানদন্ড:
১. প্রার্থীকে অবশ্যই বাংলাদেশের স্থায়ী নাগরিক হতে হবে;
২. বয়স ৫ বছর বা তদুর্ধ্ব হতে হবে;
৩. উপবৃত্তি প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিন্ধিতার মাত্রা তীব্র,মাঝারি ও মৃদু এই ক্রমধারা বিবেচনায় আনতে হবে।
৪. নি:ম্ব, উদ্বাস্তু ও ভূমিহীন প্রতিবন্ধী পরিবারের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে;
৫. সমাজসেবা অধিদফতর/জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন/ সরকার কর্তৃক স্বীকৃত স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালত প্রতিবন্ধী বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীগণ অগ্রাধিকার পাবে।
৬. দগ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্যকোন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে।
৭. এতিম/অনাথ, দুঃস্থ, আদিবাসী প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী এবং প্রতিবন্ধী পথশিশু শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদানে অগ্রাধিকারের বিষয়টি বিবেচনা আনতে হবে।
উপবৃত্তি প্রাপকের যোগ্যতা ও শর্তাবলী:
১. ’প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’ এর সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রতিবন্ধী হতে হবে;
২. বয়স ৫ বছর বা তদুর্ধ্ব হতে হবে;
৩. প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ এর ধারা ৩১ অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসাবে নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র গ্রহণ করতে হবে;
৪. প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচির আওতাভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত প্রতিবন্ধী ছাত্র- ছাত্রী হতে হবে;
৫. তালিকাভুক্ত ছাত্রছাত্রীকে ক্লাসে উপস্থিতির হার মাসে কমপক্ষে ৫০% থাকতে হবে;
৬. তালিকাভুক্ত ছাত্রছাত্রীকে নিয়মিত পরীক্ষায় অংশ গ্রহণসহ বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে;
৭. কোন প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রী নতুনভাবে স্কুলে ভর্তি হলে উল্লিখিত ৫ ও ৬ এ বর্ণিত শর্তাবলী তার জন্য
শিথিলযোগ্য; তবে পরবর্তীতে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে;
৮. বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ক্যাচমেন্ট এলাকার প্রতিবন্ধী শিক্ষাথী হতে হবে;
৯. বাছাই কমিটি কর্তৃক নির্বাচিত হতে হবে।
উপবৃত্তি প্রাপ্তির অযোগ্যতা :
১. সরকার কর্তৃক স্বীকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত না হলে;
২. প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রী কোন সরকারি/ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরত হলে;
৩. সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অন্য কোন ভাতা বা শিক্ষা অধিদফতর কর্তৃক প্রদত্ত উপবৃত্তি প্রাপ্ত হলে।
উপবৃত্তি প্রদানের স্তর ও পরিমাণ : প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের তিন মাস অন্তর ৪ (চার) কিস্তিতে উপবৃত্তি প্রদান করা হয়ে থাকে।
ক্রম |
শিক্ষার ধাপ |
শ্রেণি |
মাসিক উপবৃত্তির পরিমান (২০২৩-২৪ অর্থ বছর) |
শিক্ষার্থীর সংখ্যা (২০২৩-২৪ অর্থ বছর) |
১. |
প্রাথমিক স্তর |
১ম থেকে ৫ম শ্রেণি/সমমান শ্রেণি |
৯০০ টাকা |
৫০ জন |
২. |
মাধ্যমিক স্তর |
৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি/সমমান শ্রেণি |
৯৫০ টাকা |
১২ জন |
৩. |
উচ্চ মাধ্যমিক স্তর |
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি/সমমান শ্রেণি |
৯৫০ টাকা |
০৫ জন |
৪. |
উচ্চতর স্তর |
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর/সমমান শ্রেণি |
১৩০০ টাকা |
০৭ জন |
সর্বমোট- ৭৪ জন
সেবা প্রদানকারী অফিসের নাম:
শহর সমাজসেবা কার্যালয়-৪, ঢাকা
সেবা প্রদান পদ্ধতি (সংক্ষেপে):
সমাজসেবা অধিদফতর কর্তৃক পরিচালিত প্রতিবন্ধিতা সনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচির অন্তর্ভূক্ত সূবর্ণ নাগরিক কার্ডপ্রাপ্ত এবং সরকার কর্তৃক স্বীকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত ফরমে উপজেলা/শহর সমাজসেবা অফিসার বরাবরে আবেদন করতে হয়। নীতিমালা অনুসারে সংশ্লিষ্ট কমিটি কর্তৃক যাচাই বাছাই করার পর উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের নির্বাচন করা হয় । পূর্বে উপবৃত্তির অর্থ উত্তোলনের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান বা অভিভাবককে অবহিত করে শিক্ষার্থী/বৈধ অভিভাবকের নামে ব্যাংক হিসাব খোলা হতো। ২০২০-২১ অর্থ বছর থেকে সকল উপকারভোগীকে মাসিক ভাতা মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডার নগদ, বিকাশের মাধ্যমে জিটুপি পদ্ধতিতে (গভর্মেন্ট টু পারসন) প্রদান করা হচ্ছে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস